দাদু

by | Jun 17, 2019 | Non Fiction

নান্দাইল আমার নানীর বাড়ি আর মুক্তাগাছা আমার দাদীর বাড়ি। নানীর বাড়িতে আমার জন্যে ছিল অবারিত স্বাধীনতা আর দাদীর বাড়িতে ছিল অফুরন্ত ভালবাসা। আমার দাদা ও দাদী দুইজনই খুশিতে ব্যস্ত হয়ে যেতেন আমাদের পেলে। দাদা আনতেন বাজার করে আর দাদী ব্যস্ত হতেন রান্নায়। আমার দাদীকে আমি “দাদু” বলে ডাকি। ময়মনসিংহে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। দাদা চলে গেছেন অনেক বছর। দাদু আছেন এখনো।
ছোট বেলা আমি আমার দাদুর জন্যে পাগল ছিলাম। সবার বড় নাতি হওয়ায় (ছেলের দিক থেকে) আমার প্রতি দাদুর ছিল অন্যরকম ভালবাসা। আমি প্রতি সপ্তাহেই বায়না ধরতাম দাদুর বাড়ী যাওয়ার। সফলও হতাম আব্বাকে রাজি করাতে। আম্মার কটাক্ষ উপেক্ষা করে চলে যেতাম দাদুর সাথে দেখা করতে।
নানা ব্যস্ততা ও ঢাকায় থাকার কারনে এখন আর যাওয়া হয় না ময়মনসিংহে। যাওয়া হয় না নানুর বাড়ী-দাদুর বাড়ী। বার্ধক্যের কারনে দাদুর স্মৃতিও আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে। তবে তা সবই শোনা কথা। প্রথমবার সেটা অনুভূত হয় ঈদের দিন, অনেকদিন পরে সেদিন মোবাইল ফোনে দাদুকে পেলাম।
দাদু? আসসালামুয়ালাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে?
দাদু আমি মুনীফ।
ও মুনীফ! কেমন আছ দাদু?
ভাল আছি দাদু। তোমার শরীর ভাল?
আমিও ভাল আছি। তোমার বাবা কেমন আছে?
এই পর্যায়ে আমি একটু ধাক্কা খেলাম। আমার আব্বা (যে কিনা আমার দাদুর জ্যেষ্ঠ সন্তান) ২০১৬ সালের জানুয়ারীতে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চির বিদায় নিয়েছেন। আব্বা মারা যাওয়ার সময়, দাদু ছিলেন ইউএস -এ। বড় ছেলের নিথর দেহ তার দেখতে হয়নি। হয়ত সে জন্যেই আব্বার চলে যাওয়ার স্মৃতিটা তার জন্যে দুর্বল। আমি সামলে উঠে আবার জিজ্ঞেস করলাম।
দাদু তুমি ঠিক আছ?
হ্যাঁ। তোমার বাবা কেমন আছে?
আমাকে চিনতে পারছো?
হ্যাঁ। চিনব না কেন?
বল তো আমি কে?
মুনীফ।
তোমার বড় ছেলের নাম কি?
হেলাল।
আমি তোমার বড় ছেলের বড় ছেলে।
হ্যাঁ। হেলাল কেমন আছে?
আমি দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বললাম, “ভাল”।
আজ ঘটনাক্রমে একটা কনসালটেন্সির কাজে আমার যেতে হয় নান্দাইল এর ওয়ার্ল্ড ভিশন এরিয়া অফিসে। কাজ শেষে সিদ্ধান্ত নেই, অফিসের গাড়ি যেহেতু আছে, ঢাকা ফেরত আসার আগে মুক্তাগাছা যাব। দাদুকে দেখতে। রাস্তায় তুলে নিলাম আম্মাকে। কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে ফিরে আমার বার্ধক্য পথযাত্রী আম্মাও ক্লান্ত। কিন্তু এতদিন পরে দাদুকে দেখতে যাচ্ছি, তাও অল্প সময়ের জন্যে, আমি ভাবলাম, দাদু হয়ত আমাকে ঢাকা আসতে দিবে না, তখন বলব, “আম্মাকে রেখে যাচ্ছি তোমার কাছে”।
গাড়ী যখন আমার দাদুর “সখের কুটির” এর সামনে এসে থামল, আমি আমার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছিলাম। ড্রাইভার ভাই, দরজা খুলে দিয়ে বলল, “স্যার, নামবেন না?” আমি বাস্তবে ফেরত আসলাম। ইতস্তত করে বললাম, “হ্যাঁ। নামছি। আপনি সামনে থেকে গাড়ী ঘুরিয়ে আনেন। আমি পনের মিনিটের মধ্যে আসছি।”
অনেক সংকোচ নিয়ে লোহার ছোট দরজা গলে ভিতরে ঢুকতেই চির পরিচিত উঠান ও ইংরেজি “এল” আকৃতির বাড়িটি গোচর হল। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। দাদুর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ডাকতে লাগলাম, “দাদু… দাদু…”
কে এসছে?
“দাদু, আমি মুনীফ।” দাদুর পাশে গিয়ে বসলাম। দাদুও উঠে বসলেন। আম্মা পিছনে ছিল। দাদু আম্মার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ও কে?” আমি বললাম, “ও হচ্ছে তোমার ছেলে হেলাল এর বউ, আমা্র আম্মা, জ্যোৎস্না।”
কি বলে? নাহ!
এইবার আম্মার অবাক হবার পালা। আম্মা বলল, “আমি আপনার বউমা। আপনার জন্যে না সেইদিন কবিতা লিখলাম, ‘বকুল রাণীর রাজপ্রাসাদ…?'” দাদু শিশুর মত ফিক করে হেসে দিলেন, “না তুমি জ্যোৎস্না না। কিন্তু তোমার চেহারা অনেক চেনা চেনা লাগছে।” এই পর্যায়ে, আমি পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিলাম। “দাদু, জ্যোৎস্না দেখতে কেমন? অল্প বয়স?” দাদু মাথা নেড়ে আমার সাথে সহমত পোষণ করলেন। আমি বললাম, “তুমি যেরকম বৃদ্ধ হচ্ছ, জ্যোৎস্নাও বৃদ্ধ হচ্ছে। তার চেহারায়ও পরিবর্তন আসছে। এইজন্যে চিনতে পারছ না।”
পনেরো মিনিটের পুরোটাই চলে গেল পরিচয় পর্ব সারতে। আম্মা আমাকে বলছিলেন যে দাদু নাকি ইদানিং কমলা খুব খেতে পছন্দ করে। আমি সেই জন্যে যাওয়ার আগে, কমলা, মাল্টা, আপেল ও এক বাক্স বিস্কুট কিনে নিয়ে যাই। কাগজে মোড়ানো প্রতিটি ঠোঙা রাখি তার সামনে। “দেখ তোমার জন্যে কি নিয়ে এসেছি।”
“কি এটাতে?” বলে খুশিতে একটার পর একটা ঠোঙা ছিঁড়তে লাগলেন দাদু। কমলা দেখে আরও খুশি হয়ে গেলেন। আম্মাকে বললাম কমলার খোসা ছাড়িয়ে দিতে। আম্মা খোসা ছাড়িয়ে দাদুর হাতে তুলে দিলেন কমলা। দাদু খুশি মনে কমলার কোয়া মুখে পুরতে লাগলেন, আর আমার দৃষ্টি ঝাপসা হতে শুরু করল।
রীতি অনুযায়ী দাদু আমাকে আপ্যায়ন করা নিয়ে ব্যস্ত হতে চাইলেন। দাদুর স্মৃতি লোপের সুযোগ নিয়ে বললাম, “আমরা সবাই খেয়েছি দাদু।” সেটা শুনে দাদু শান্ত হলেন। দাদু আমার হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। আমি দাদুকে ধরে দাঁড়াতে সাহায্য করলাম। আমার সাথে দাদু বারান্দার সোফায় এসে বসলেন। আমি দাদুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম অনেকক্ষণ। দাদু কান্না কান্না সুরে বললেন, “এত আদর দিও না, ফুরিয়ে যাবে।” চোখের পানি চেপে বললাম, “ফুরাবে না দাদু।”
“কেমন করে যেন অনেক একা হয়ে গেলাম।” হতাশার সুরে বললেন দাদু।
আম্মা পিছন থেকে বললেন, “আমরা সবাই একা, এসেছি একা, যাবও একা।”
আমি দাদুকে বললাম, “চল দাদু, তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাব। ঢাকায়।”
কখন?
এখন। তুমি আমার সাথে, স্নেহ আপুর সাথে থাকবে। স্নেহ আপু সবসময় তোমার কথা বলে।
নিজের বাড়ী ছেড়ে কোথাও যাব না।
“কি আছে এখানে?”, রেগে গিয়ে বললাম।
বারান্দার ওপারে রঙ্গন ফুলের গাছের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, “ফুল”।
আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। দাদুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “দাদু, আমার যেতে হবে।” দাদু, আমাকে থামাতে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সাথে সাথে আমি বললাম, “আম্মাকে রেখে যাচ্ছি তোমার কাছে। আজকে রাতে তোমার সাথে থাকবে। আমার দুইটা মিটিং আছে ঢাকায়।”
দাদু আবার আমাকে ধরে উঠে দাঁড়ালেন। আমার বারণ অগ্রাহ্য করে হেঁটে হেঁটে আমার সাথে দরজা পর্যন্ত আসতে লাগলেন। “দাদু, তোমার এগিয়ে দিতে হবে না।”
“দরজা পর্যন্তই তো যাব।” হাসলেন দাদু।
আমি উঠান পেরিয়ে সেই লোহার ছোট দরজা গলে বাইরে বের হওয়ার সময় চিন্তা করলাম যে আর পেছন ফিরে তাকাবো না। কিন্তু মন কে আর ফেরাতে পারলাম না। শেষবারের মত পেছনে তাকালাম। দাদুর হাসিমুখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অনেক কষ্টে হাত তুলে নারলাম বিদায়ী ভঙ্গিতে। দাদুও হাত তুলে বিদায় জানালেন।
গাড়ীতে উঠে, ড্রাইভার ভাইকে কান্নাজরিত কন্ঠে বললাম, “সরি ভাই, একটু দেরী হয়ে গেল। চলেন।”
উনি কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলেন,  “কি যে বলেন স্যার।”
আমি আমার ল্যাপটপ খুলে লিখতে বসলাম। চোখে ভাসছিল দাদুর হাসি। কানে বাজছিল ক্রমান্বয়ে মৃদু হতে থাকা দাদুর কণ্ঠস্বর। কিবোর্ড এ পরছিল নোনা জল।

Written By A F M Munif Mushfiq Khan

undefined

Related Posts

স্বৈরাচার পতনের পর নাগরিকদের করণীয়

স্বৈরাচার পতনের পর নাগরিকদের করণীয়

একজন স্বৈরাচারের পতন একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা নিয়ে আসে। তবে, এই মুক্তির মুহূর্তটি দ্রুত বিশৃঙ্খলায় পরিণত হতে পারে যদি নাগরিকরা দায়িত্বশীলভাবে কাজ না করে। আইন ও শৃঙ্খলার অনুপস্থিতিতে, বেআইনি কার্যকলাপ সমাজের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।...

read more
আব্বা

আব্বা

হাতে এতগুলো কাজ, কিন্তু কিছুতেই মন বসছে না। সবকিছু ছেড়ে দিয়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার যে ইচ্ছাটি আমার মাঝে মাঝে করে, সেটি আজকে একটু প্রবল। ব্যস্ততার কারনে, নতুন ভাড়া বাসায় এক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও, বাসার সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারি নি এখনো। এই শীতের ছুটিতে, অনেকটুকু কাজ...

read more
বিয়ে

বিয়ে

চারপাশে অনেক সমস্যা। থাকি ঢাকায় -সমস্যার শহর। অবাসযোগ্য শহর হিসেবে আমরা এই মুহূর্তে বিশ্বের তৃতীয় (Global Liveability Index 2019)। এইটাও সমস্যা। গত বছর আমরা দ্বিতীয় ছিলাম। এইবার এক ধাপ পিছিয়ে গেলাম। আমাদের অবস্থা এখন ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মত -অপুষ্ট ও অবহেলিত।...

read more

0 Comments