হাতে এতগুলো কাজ, কিন্তু কিছুতেই মন বসছে না। সবকিছু ছেড়ে দিয়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার যে ইচ্ছাটি আমার মাঝে মাঝে করে, সেটি আজকে একটু প্রবল। ব্যস্ততার কারনে, নতুন ভাড়া বাসায় এক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও, বাসার সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারি নি এখনো। এই শীতের ছুটিতে, অনেকটুকু কাজ এগিয়ে নিয়েছি যদিও। সৌভাগ্যক্রমে আম্মা ছিল সাথে, তাই সেও তার মত কিছু গোছগাছ করল। গোছানোর এক পর্যায়ে আম্মা দৌড়ে আমার কাছে এল, “মুনীফ, দেখ কি পাইসি!” আমি পুরনো বইয়ের স্তুপ থেকে মাথা তুলতেই দেখলাম আম্মা হাতে ছোট একটা
কালো পাউচ নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মুহূর্তেই চিনতে পারলাম -আব্বার রক্তে চিনির পরিমাণ মাপার যন্ত্র।
বিভিন্ন সময়ে আমার দুই চাচা ও তাদের পরিবার এর পক্ষ থেকে প্রায়ই যন্ত্রগুলো পেতাম। আব্বা খুব আগ্রহ নিয়ে তার রক্ত পরীক্ষা করতো। আর খুব রুটিন করে সুচ দিয়ে ইনসুলিন নিতো নিজের উরুতে। আম্মা অথবা আমি উপস্থিত থাকলে, আব্বা আমাদেরকে দিয়েই কাজগুলো করাতো। যার সুফলে ইনজেকশন পুশ করার অনেক বছরের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। আম্মার হাসপাতালের চাকরীর সুবাদে ছোটবেলা থেকেই হাসপাতালে ছিল অবারিত যাওয়া-আসা। তারপরেও কেন জানি, যখনি হাসপাতালে যাই, অথবা কোন পরীক্ষার জন্যে রক্ত দিতে হয়, একটা চাপা অস্বস্তি ও অজানা ভীতি কাজ করে।
আব্বা সবকিছুই আনন্দের সাথে করতো -প্রতি বেলা অজস্র ঔষধ খাওয়া, তিন বেলা ইনসুলিন নেওয়া, রক্ত পরীক্ষা করা, এবং সর্বপরি একজন ডায়েবেটিক রোগীর জন্যে যে সকল খাবার ও তার পরিমাণ সম্পর্কিত নিয়ম নির্ধারণ করা আছে, তা সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে অগ্রাহ্য করা। এই ব্যপারে কোন সতর্কীকরণ করা হলে সে তার চিরাচরিত রসিকতার সুরে বলত, “খাইলেও মরমু, না খাইলেও মরমু। তাইলে খাইয়াই মরি।” এর পরে কেউ আর আব্বার সাথে তর্কে যেত না।
কষ্ট লাগে এই ভেবে যে শেষের কয়েক বছর, সেই ভোজনপ্রিয় মানুষটি কোন কিছু আনন্দ নিয়ে খেতে পারত না। একটু খেলেই বমি হতো। যখনি ইউনিভার্সিটি ছুটি হতো আর আমি ময়মনসিংহ যেতাম, এই দৃশ্য দেখতে হতো। সহ্য করতে পারতাম না। আবার আব্বার সামনে ভেঙ্গেও পরতাম না। মনের অজান্তেই ময়মনসিংহ যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলাম। ঈদের ছুটি নিতাম না। ওভারটাইম করতাম। এখন বুঝি, আমি খুবই দুর্বল চিত্তের একজন মানুষ।
আব্বার চলে যাওয়ার খবরটা যখন আমি আম্মার কাছ থেকে ফোনে পেলাম, আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। অনেক ফোন আসছিল। কোনো ফোন ধরতে ইচ্ছা করছিল না। ভেতরটা ফাঁকা লাগছিল। আর অনেক রাগ হচ্ছিল আব্বার উপর। অনেকগুলো জানা ও অজানা অনুভূতির সে এক কিম্ভূতকিমাকার সংমিশ্রণ! অনেকক্ষণ আমি এয়ারপোর্টের রাস্তায় বসে ছিলাম।
নিথর একটা দেহ, যেখানে আমার আব্বার কোন অস্তিত্ব আর নেই, যার কাছে কোন প্রশ্নের আর উত্তর পাওয়া যাবে না, যে কিনা আর কখনোও রসিকতার ছলে উদ্ভট সব যুক্তিবিহীন যুক্তি দেবে না, সেই সুপরিচিত কিন্তু নির্বাক দেহের সাথে আমি কিভাবে নতুন করে পরিচিত হব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার ক্ষণগুলো কাটিয়ে, শেষে সাহস জোগার করলাম। রওনা হলাম। যাত্রার লম্বা সময়টিতে, তার স্মৃতিগুলোয় চোখ বুলিয়ে গেলাম কয়েকবার। যখন উঠানে আব্বার লাশ দেখলাম, একটুও কাঁদলাম না। কোনো প্রশ্নও করলাম না। করলাম না কোন কিছু শোনার আশা। শুধু কপালে একটা চুমু দিয়ে বললাম “আই এম সরি। ফরগিভ মি। আই লাভ ইউ।” হয়ত ছোটবেলা সেও ঠিক একই ভাবে আমার কপালে চুমু দিয়ে তার ভালবাসার কথাটি আমাকে জানিয়েছে। আমরা কেউই কখনোও একে অপরের প্রতি ভালবাসা এভাবে প্রকাশ্যে প্রকাশ করি নি। সবই করেছি আড়ালে।
আজ থেকে ঠিক চার বছর আগে, এই দিনে, আমি আমার আব্বাকে চির বিদায় দেই। আজকের সেই একই দিনে, আমার ভালবাসার সেই মানুষটির জন্মদাত্রী মা, আমার দাদু, হাসপাতালের আই সি ইউ তে কষ্ট ভোগ করছেন। কিভাবে আরও একবার এই নির্মম বাস্তবতার সম্মুখীন হব? কিভাবে আমার চূর্ণ হৃদয়ের টুকরোগুলিকে কুঁড়িয়ে, একসাথে জুড়ব? চিন্তা করেই চোখে হঠাৎ পানি চলে আসলো, বুক ভিজলো, আর দীর্ঘশ্বাসের সাথে কন্ঠনালী থেকে শুধু একটা শব্দই বের হয়ে আসল, “আহ!”
(এই পোস্টটি লিখার তিন ঘন্টা পরে আমার দাদু না ফেরার দেশে চলে যান। উনার বিদেহী আত্মার উপরে শান্তি বর্ষিত হোক।)
0 Comments